শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলির জন্য ঘুষ বাণিজ্য
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলির জন্য ঘুষ বাণিজ্য: নৈতিকতা ও নীতির মারাত্মক বিপর্যয়

বাংলাদেশের শিক্ষাখাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকট ও দুর্নীতির কারণে জনআস্থার চরম দুর্দশায় পড়েছে। তবে সাম্প্রতিক একটি সংবাদ নতুন করে আলোচনায় এনেছে এমন এক বাস্তবতাকে, যা শুধু উদ্বেগজনকই নয় বরং গোটা জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানোর কারণ হতে পারে।
সম্প্রতি "আমার দেশ" পত্রিকার এক অনুসন্ধানভিত্তিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, "শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলির জন্য সবচেয়ে বেশি ঘুষ বাণিজ্য হয়।" এ দাবি কোনো সাধারণ অভিযোগ নয়, বরং সরকার-নিযুক্ত উপদেষ্টাদের বক্তব্য ও একাধিক জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে তা প্রকাশিত হয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের হাত ধরেই যখন ঘুষের এমন সাংগঠনিক রূপ দেখা যায়, তখন প্রশ্ন জাগে: শিক্ষাকে কি আমরা শুধুই চাকরির পণ্য বানিয়ে ফেলছি?
📌 ঘুষ বাণিজ্যের চিত্র: কীভাবে চলছে এই অশুভ চক্র?
বদলি নিয়ে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে এই ঘুষ সিন্ডিকেটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, তা একাধিক উৎস থেকে স্পষ্ট।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বদলির সময় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কাছ থেকে দশ হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করা হয়, যা প্রায়শই মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে আদায় করা হয়।
অভিযোগ আছে, বদলি কিংবা পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত নীতিমালা না মেনে, কেবলমাত্র টাকার বিনিময়ে স্থান নির্ধারণ করা হয়। এমনকি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও এক কোটি টাকার ঘুষ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে একটি খোদ সরকারি সূত্রে প্রকাশ পায়।
📊 জরিপ যা বলছে
সরকারি একাধিক জরিপ এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) এর তথ্য অনুযায়ী,
- সেবাপ্রাপ্তদের প্রায় ৩১ শতাংশই কোনো না কোনো সরকারি সেবার জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হন।
- এর মধ্যে শিক্ষা খাতে ঘুষ প্রদানের হার আশঙ্কাজনকভাবে উঁচু।
- বদলির ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ পরিমাণ ঘুষ লেনদেন হয়, যা প্রায় একটি নিয়মিত বাজারের রূপ নিয়েছে।
⚠️ শিক্ষার মর্যাদা কি শুধু টাকার বিনিময়ে?
শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড, এটি নীতি, নৈতিকতা এবং আদর্শের প্রতীক। কিন্তু যখন এই শিক্ষাক্ষেত্রই অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায়, তখন প্রশ্ন জাগে—এই জাতির ভবিষ্যৎ কোথায়?
ঘুষ দিয়ে বদলি হওয়া শিক্ষক হয়তো প্রিয় অঞ্চলে পোস্টিং পান, কিন্তু সেখানে তাঁর কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কতটুকু থাকবে? কেবল ঘুষ দিয়ে পদে বসা মানুষ কীভাবে আগামী প্রজন্মকে সততা ও নৈতিকতার পাঠ শেখাবে?
কী করণীয়?
এই সংকট থেকে উত্তরণে কয়েকটি বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ এখন জরুরি:
- বদলি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে অনলাইনে পরিচালনা করা।
- ঘুষ বা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
- নিয়োগ ও বদলি প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
- দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা।
- শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও নৈতিকতা রক্ষায় বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
🧭 উপসংহার
শিক্ষা খাতের প্রতি জাতির প্রত্যাশা সর্বোচ্চ। কিন্তু যদি এই খাতটাই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তবে উন্নত ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়া শুধু কল্পনা হয়েই থাকবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ঘিরে ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে শুধু প্রশাসনিক নয়, নৈতিক বিপ্লব দরকার—যেখানে শিক্ষক, নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষ একত্রে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন।
এখন সময় এসেছে—শিক্ষার পবিত্রতা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের। নইলে "ঘুষের বিনিময়ে বদলি" হবে আগামী দিনের নতুন নিয়ম, আর সততার পথ বেছে নেওয়া শিক্ষকরা হারিয়ে যাবেন এই দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থার আড়ালে।
No comments