নাঙ্গলকোটের ইতিহাস।
নাঙ্গলকোট: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সম্ভাবনার জনপদ

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত একটি ঐতিহ্যবাহী উপজেলা নাঙ্গলকোট। ইতিহাসের পাতায় যার রয়েছে গৌরবময় উপস্থিতি, আর বর্তমানে এটি শিক্ষার অগ্রযাত্রা, প্রবাসী আয়, এবং রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে পরিচিত। কুমিল্লা জেলার এই জনপদে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, প্রাচীন জমিদার বাড়ির ইতিহাস এবং কৃষিনির্ভর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি।
নাঙ্গলকোট নামটির উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও স্থানীয় প্রবীণদের মতে, এই অঞ্চলে প্রাচীনকালে লাঙ্গল (নাঙ্গল) দিয়ে চাষাবাদ প্রচলিত ছিল এবং 'কোট' শব্দটি এসেছে প্রাচীন জনপদ বা বাজারকে বোঝাতে। অর্থাৎ, এটি ছিল একটি কৃষি-সমৃদ্ধ বসতি ও বাজারের সংমিশ্রণ। সেখান থেকেই নামকরণ হয় 'নাঙ্গলকোট'।
নাঙ্গলকোট একসময় টিপরা রাজ্যের অংশ ছিল। এই অঞ্চলে মোঘল ও ব্রিটিশ শাসনের চিহ্ন পাওয়া যায়। স্থানীয় জমিদারগণ ইংরেজ শাসকদের সহায়তায় ভূমি শাসন করতেন। এখানকার আদ্রা জমিদার বাড়ি এবং দারোয়ান বাজার জমিদার বাড়ি সেই ঐতিহ্য বহন করছে। আজও এসব স্থাপনার স্থাপত্যরীতিতে প্রাচীন বাংলার ছোঁয়া স্পষ্ট।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নাঙ্গলকোট উপজেলার মানুষ অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। এখানকার বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ। বিশেষ করে দৌলতপুর, আদ্রা, ও হাসানপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল। নাঙ্গলকোটের শহীদ পরিবারের সংখ্যা অনেক, যাদের আত্মত্যাগ এ এলাকার গৌরব।
নাঙ্গলকোট বাংলাদেশের অন্যতম প্রবাসী অধ্যুষিত উপজেলা। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকায় বসবাসরত হাজার হাজার প্রবাসী এই উপজেলার আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছে। এখানকার বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা, হাসপাতাল প্রবাসীদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত।
নাঙ্গলকোটে শতবর্ষ প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম:
প্রতিষ্ঠানের নাম | প্রতিষ্ঠার সাল |
---|---|
নাঙ্গলকোট পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় | ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ |
আদ্রা ইসলামিয়া আলিয়া মাদ্রাসা | ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ |
হাসানপুর ডিগ্রি কলেজ | ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ |
দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় | ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ |
এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সাংস্কৃতিক দিক থেকে এখানকার মেলা, গাজীর গান, পুঁথি পাঠ ও ইসলামী জলসা জনপ্রিয়।
নাঙ্গলকোটের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। ধান, পাট, আলু, সবজি ও মাছের উৎপাদনে উপজেলার ভূমিকা ব্যাপক। এখানে গ্রামীণ হাটবাজারগুলো যেমন—দৌলতপুর, চৌধুরীপাড়া, আদ্রা, হেসাখাল, হাসানপুর, এসব বাজারই কৃষিপণ্য বিপণনের কেন্দ্রস্থল।
নাঙ্গলকোটে ধর্মীয় সহাবস্থান চমৎকার। এখানে প্রাচীন বহু মসজিদ ও মন্দির রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় স্থাপনা:
- চর সিংগলা শাহী জামে মসজিদ
- আদ্রা জামে মসজিদ (প্রায় ২০০ বছরের পুরনো)
- দৌলতপুর সার্বজনীন দুর্গা মন্দির
ধর্মীয় সম্প্রীতি এই উপজেলায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নাঙ্গলকোটের জমিদার বাড়িগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু এখনো টিকে আছে, কিছু বিলুপ্তির পথে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি:
আদ্রা জমিদার বাড়ি – এখানকার নকশা ও দরজা-জানালায় মোঘল রীতির প্রভাব দেখা যায়।
দারোয়ানবাজার জমিদার বাড়ি – এখানে জমিদারদের ব্যবহৃত কামান, নকশীকৃত দরজা ও পুকুরঘাট এখনো লোক চেনে।
নাঙ্গলকোট রেলপথ ও সড়কপথে বেশ উন্নত। হাসানপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কুমিল্লা ও ঢাকা অভিমুখে ট্রেন চলে। এছাড়া পাকা সড়ক ও সেতুর মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রামগুলো উপজেলা সদর ও জেলায় সংযুক্ত।
- আবুল খায়ের ভূঁইয়া – বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ও সাংসদ।
- ড. ফখরুল ইসলাম – আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক ও লেখক।
বর্তমানে নাঙ্গলকোটের প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে গেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, নারীর ক্ষমতায়নও দৃশ্যমান। এখানকার প্রবাসীদের রেমিটেন্স, কৃষিজ উৎপাদন এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে এ জনপদ আগামীর একটি আধুনিক উপজেলা হয়ে উঠছে।
নাঙ্গলকোট কেবল কুমিল্লার একটি উপজেলা নয়, বরং এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সম্ভাবনার এক অনন্য প্রতিচ্ছবি। জমিদার আমলের ঐশ্বর্য, মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রবাসী সহায়তায় গঠিত অর্থনীতি—সব মিলিয়ে নাঙ্গলকোট একটি গৌরবোজ্জ্বল জনপদ। এ অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গল্প, যা ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে।
No comments