সমাজের এক অদৃশ্য শৃঙ্খল
আজকের সমাজে সবচেয়ে বড় ভয়গুলোর একটি হলো চাকরি হারানোর ভয়। মানুষ যতটা না অন্যায়কে ভয় পায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পায় বেকারত্বকে। বেকার হয়ে গেলে সমাজে সম্মান কমে যাবে, পরিবার অনিশ্চয়তায় পড়বে, সংসারের খরচ চালানো কঠিন হয়ে যাবে এই ভয় মানুষকে সত্য বলার পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন এ বিষয়ে একটি গভীর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি একবার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন, প্রতিষ্ঠানের বস কর্মচারীদের overtime-এর টাকা কেটে নিচ্ছেন। সবাই জানতো এটি অন্যায়, কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেনি। কারণ, চাকরি হারানোর ভয় তাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছিল।
ভয়ের কারণে ন্যায় হারানো
মানুষ যখন চাকরির নিরাপত্তাকে ন্যায়ের চেয়ে বড় করে দেখে, তখন অন্যায় ক্রমশ বেড়ে যায়। বস বা কর্তৃপক্ষ তখন বুঝে যায় যে, কর্মচারীরা প্রতিবাদ করবে না। এই সুযোগে তারা আরও বেশি শোষণ শুরু করে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার তার সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন
"তুমি কেন চুপ করে আছো?"
সহকর্মী উত্তর দিয়েছিলেন
"আমার সন্তানদের পড়াশোনার খরচ কিভাবে চালাবো? এই চাকরিটা হারালে আমি রাস্তায় বসে যাব।"
এখানেই স্পষ্ট যে, ভয় মানুষকে সত্য থেকে দূরে রাখে। অথচ ন্যায় হারালে শেষ পর্যন্ত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভয় ভাঙতে না পারার পরিণতি
যদি একটি প্রতিষ্ঠান বা সমাজে কর্মচারীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ায়, তবে কয়েকটি খারাপ ফল দেখা দেয়:
- শোষণ বেড়ে যায় – বসরা জানে কেউ কিছু বলবে না, তাই তারা আরও চাপ সৃষ্টি করে।
- মানসিক চাপ বাড়ে – কর্মচারীরা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ থাকে, কিন্তু প্রকাশ করতে না পারায় হতাশা বাড়ে।
- সত্য হারিয়ে যায় – একসময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, সত্য বলার সাহস কেউ রাখে না।
- সমাজে অন্যায় স্বাভাবিক হয়ে যায় – মানুষ ভেবে নেয় যে, এটাই বাস্তবতা।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এই ধরনের পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী হলে কর্মচারীদের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। তারা শুধু মেশিনের মতো কাজ করে, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আর ভাবে না।
চাকরির ভয়: পরিবার ও সমাজের চাপ
চাকরির ভয় শুধু ব্যক্তিগত ভয় নয়, পরিবার থেকেও এই ভয় চাপিয়ে দেওয়া হয়।
- বাবা-মা সন্তানকে বারবার বলে: "চাকরিটা ধরে রাখো, মুখ খুলে ঝামেলায় যেও না।"
- স্ত্রী বা স্বামী বলে: "এখন চাকরি হারালে সংসার চলবে না, চুপ করে থাকাই ভালো।"
- সমাজ বলে: "চাকরিহারা মানুষ ব্যর্থ, সম্মানহীন।"
এইভাবে ভয়কে সমাজ কাঠামোগতভাবে চাপিয়ে দেয়। ফলে মানুষ নিজের নৈতিকতার চেয়ে চাকরির নিরাপত্তাকে বড় মনে করে।
ন্যায়ের দাবি কেন গুরুত্বপূর্ণ
মানুষ যদি কেবল ভয়ে চুপ থাকে, তবে অন্যায় কখনো শেষ হয় না। কিন্তু যদি সত্য বলা হয়, ন্যায়ের দাবি করা হয়, তবে পরিবর্তন সম্ভব।
আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার সাহস নিয়ে প্রতিষ্ঠানের বসের কাছে গিয়ে বলেছিলেন—
"আপনি আমাদের overtime-এর টাকা কেটে নিতে পারেন না। আমরা কাজ করেছি, তাই আমাদের অধিকার দিতে হবে।"
প্রথমে সবাই ভেবেছিল তিনি চাকরি হারাবেন। কিন্তু যখন প্রমাণসহ কথা বললেন, তখন বস বাধ্য হলো টাকা দিতে। এই ঘটনায় সহকর্মীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
ইতিহাসের শিক্ষা
ইতিহাসে দেখা যায়, যারা চাকরি বা অবস্থান হারানোর ভয় না করে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তারাই সমাজে বড় পরিবর্তন এনেছে।
- লালন ফকির চাকরি বা সম্পদ নিয়ে ভাবেননি, সত্য কথা বলেছিলেন।
- বিশ্ব ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীও ব্রিটিশদের চাকরি বা সুবিধার ভয় না করে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
তাদের সাহস আজ ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে।
ভয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া
চাকরির ভয় ভাঙতে কয়েকটি কৌশল কার্যকর হতে পারে:
- সম্মিলিত শক্তি তৈরি করা – একা দাঁড়ালে ভয় বেশি হয়, কিন্তু সবাই মিলে দাঁড়ালে ভয় কমে যায়।
- প্রমাণ ও যুক্তি ব্যবহার করা – অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে শক্ত প্রমাণ প্রয়োজন।
- আইনি সুরক্ষা নেওয়া – অনেক দেশে শ্রম আইন কর্মচারীদের অধিকার রক্ষা করে। এগুলো জানা ও কাজে লাগানো দরকার।
- নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ – ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে যে সত্যের জন্য চাকরি হারানোও সম্মানের, কিন্তু অন্যায় মানা লজ্জার।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বারবার জোর দেন যে, ভয় ভাঙতে হলে মানুষকে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে।
চাকরির ভয় সমাজকে নীরব করে রাখে, কিন্তু ন্যায়ের দাবি সমাজকে জীবন্ত করে তোলে। একজন মানুষ যদি ভয় না করে সত্য বলে, তবে অন্যরা সাহস পায়। এভাবেই ধীরে ধীরে একটি সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
আব্দুল্লাহ আল মামুনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, ভয়কে জয় করা সম্ভব। সাহস, প্রমাণ, এবং ঐক্য থাকলে চাকরি হারানোর ভয় থেকেও বড় শক্তি হলো ন্যায়।
ভয়ের সংস্কৃতি চুপ থাকার শিক্ষা
আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখি "চুপ করে থাকো"। স্কুলে শিক্ষক অন্যায় করলে ছাত্রদের বলা হয়—চুপ থাকো। অফিসে বস অন্যায় করলে সহকর্মীরা বলে—চুপ থাকো। এমনকি বাড়িতেও বয়োজ্যেষ্ঠরা অন্যায় করলে ছোটরা মুখ খুলতে পারে না। এভাবে চুপ থাকার অভ্যাস সমাজকে অসুস্থ করে তোলে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, একবার তিনি দেখেছিলেন তার অফিসে নতুন একজন কর্মচারীকে বিনা কারণে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। সবাই জানত এটি অন্যায়, কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। কারণ, সবাই ভয় পাচ্ছিলেন—"যদি আমি প্রতিবাদ করি তবে আমাকেও বাদ দেওয়া হবে।"
এই ভয়ের সংস্কৃতি এমন এক শৃঙ্খল তৈরি করে যেখানে অন্যায়কে স্বাভাবিক মনে হতে শুরু করে।
চাকরি হারানোর ভয় বনাম মর্যাদা হারানোর ভয়
চাকরি হারালে মানুষ ভাবে, পরিবার চলবে না, সম্মান নষ্ট হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করলে মর্যাদাই বেশি হারায়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন।
"চাকরি হারানোতে এক মাস কষ্ট হতে পারে, কিন্তু ন্যায় হারালে সারাজীবনের কষ্ট।"
একজন মানুষ চাকরি হারিয়ে আবার নতুন কাজ খুঁজে নিতে পারে, কিন্তু একবার যদি অন্যায়কে মেনে নেয়, তবে তার বিবেক ধীরে ধীরে মরে যায়।
ভয়ের কারণে সৃজনশীলতা নষ্ট হওয়া
যখন মানুষ সবসময় ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকে, তখন তার সৃজনশীলতা কমে যায়। সে শুধু বসের নির্দেশ পালন করে, নতুন কিছু ভাবতে চায় না।
একটি কোম্পানিতে দেখা যায়, যেসব কর্মচারী সত্য বলতে ভয় পায়, তারা কখনো বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে না। বরং যারা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়, তারাই সাহসী সিদ্ধান্ত নেয় এবং নেতৃত্বে এগিয়ে যায়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার একটি মিটিংয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে কোম্পানির একটি নীতি কর্মচারীদের ক্ষতি করছে। প্রথমে সবাই তাকে থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে বসও স্বীকার করেন তিনি ঠিক বলেছেন। এর পর থেকে সেই নীতি পরিবর্তন হয় এবং কর্মচারীরা উপকৃত হয়।
চাকরির ভয় ভাঙার উপায়
চাকরির ভয় ভাঙতে মানুষকে কয়েকটি মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে।
- নিজের যোগ্যতার প্রতি আস্থা রাখা – একজন কর্মচারী যদি মনে করে, সে অন্য কোথাও কাজ পাবে না, তবে সে ভয়ে থাকবে। কিন্তু যদি আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে সে সত্য বলতে দ্বিধা করবে না।
- ঐক্য তৈরি করা – একা দাঁড়ানো কঠিন, কিন্তু সবাই একসাথে দাঁড়ালে ভয় ভেঙে যায়।
- আইনের সাহায্য নেওয়া – শ্রম আইন জানা জরুরি। অনেক সময় আইনই কর্মচারীদের সুরক্ষা দেয়।
- আত্মমর্যাদাকে বড় করে দেখা – চাকরি সাময়িক, কিন্তু মর্যাদা সারাজীবনের। এই শিক্ষা হৃদয়ে নিতে হবে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, একবার তিনি আরেক সহকর্মী মিলে বসকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কর্মচারীদের ছুটি না দেওয়া অন্যায়। একা হলে হয়তো তিনি কিছু করতে পারতেন না, কিন্তু দুজন একসাথে সাহস পেয়েছিলেন।
সমাজে চাকরির ভয়: একটি চিত্র
বাংলাদেশের মতো দেশে চাকরির ভয় আরও গভীর। কারণ, এখানে বেকারত্বের হার বেশি। একটা চাকরি পেলে মানুষ সেটি আঁকড়ে ধরে। ফলে বসরা বা কর্তৃপক্ষরা জানে—"এরা কিছু বলবে না।"
এখানে দেখা যায়:
- সরকারি চাকরিতে অন্যায় হলে মানুষ চুপ থাকে, কারণ চাকরি খুবই 'সুরক্ষিত'।
- বেসরকারি চাকরিতে চুপ থাকে, কারণ চাকরি হারালে বিকল্প নেই।
- এনজিও বা গার্মেন্টস সেক্টরে কর্মচারীরা প্রায়ই শোষিত হয়, কিন্তু প্রতিবাদ করলে চাকরি হারায়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এভাবে নীরব থেকে থেকে একটি জাতি দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শেখে না।
ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগ
ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। চাকরি হারানো তার একটি অংশ।
- শহীদ তিতুমীর জমিদারদের অন্যায় মেনে নেননি, নিজের জীবন দিয়েছেন।
- বিদেশে নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছর জেল খেটেছেন, কিন্তু সত্য থেকে সরে আসেননি।
তাদের আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে চাকরি বা পদ সাময়িক, কিন্তু সত্য চিরকাল বেঁচে থাকে।
নীরবতার বিপদ
যদি সবাই চাকরির ভয়ে নীরব থাকে তবে সমাজে কয়েকটি বিপদ তৈরি হয়:
- অন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- মানুষ নৈতিকতা হারায়।
- দুর্নীতি বেড়ে যায়।
- নতুন প্রজন্ম ভয় শেখে, সাহস নয়।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, "যদি বাবা-মা চুপ থাকে, সন্তানরা কখনো সত্য বলতে শিখবে না।"
চাকরির ভয় মানুষকে নীরব করে রাখে, কিন্তু ন্যায়ের দাবি মানুষকে শক্তি দেয়। সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে হলে চাকরির ভয় ভাঙতেই হবে।
তাই সমাজে যদি পরিবর্তন আনতে হয়, তবে প্রতিটি মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—চাকরির ভয় নয়, ন্যায়ের দাবিই আমাদের পথ।
আমাদের শেখায় যে ভয়কে জয় করার মাধ্যমেই কেবল একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গঠন সম্ভব। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই সাহস বিকশিত করতে পারলেই আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারব।
Join the conversation