
বিদেশে কর্মরত একজন বাংলাদেশি মানে দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। প্রতিদিন ঘাম ঝরিয়ে, কষ্ট করে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন তারা। অথচ সেই প্রবাসীদের জন্য নিজের দেশের জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় শত্রু। ওমানের রাজধানী মাস্কাট থেকে চট্টগ্রাম রুটে আগস্টের ১৩ তারিখের টিকিটের দাম দেখে বোঝা যায়—এই প্রতিষ্ঠান যেন প্রবাসীদের পকেট খালি করার জন্যই চলছে।
টিকিট ভাড়ার তুলনা: লজ্জাজনক বৈষম্য
এয়ারলাইন | সময় | ভাড়া | টিকিট সময় |
---|---|---|---|
SalamAir | রাত ০১:০৫ → সকাল ০৮:০০ | ৩১ ওমানি রিয়াল (প্রায় ৯,০০০ টাকা) | ৪ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট |
US-Bangla Airlines | রাত ০২:০০ → সকাল ০৮:৪৫ | ৫৬ ওমানি রিয়াল (প্রায় ১৬,২০০ টাকা) | ৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট |
Biman Bangladesh Airlines | বিকেল ১৪:১০ → রাত ২১:০০ | ৭৯ ওমানি রিয়াল (প্রায় ২২,৯৫০ টাকা) | ৪ ঘণ্টা ৫০ মিনিট |
একই রুট, একই আকাশ, একই সময়ের কাছাকাছি ফ্লাইট—কিন্তু নিজের দেশের বিমান সংস্থার টিকিটই সবচেয়ে বেশি। বিদেশি সালাম এয়ার যেখানে মাত্র ৩১ রিয়ালে চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ বিমান গিলে ফেলছে ৭৯ রিয়াল! প্রশ্ন জাগে—বাংলাদেশের কি কুকুর কামড়েছে? নিজের নাগরিকের জন্য তো ভাড়া আরও কম হওয়ার কথা, উল্টে তিন গুণ দাম চাওয়া হচ্ছে কেন?
বাংলাদেশী হয়ে বাংলাদেশীর জন্য সবচেয়ে বেশি দাম — এটা কি স্বাভাবিক?
আমরা প্রবাসীরা শুধু যাত্রী নই, আমরা দেশের অর্থনৈতিক যোদ্ধা। এই যোদ্ধাদের জন্য বিদেশি এয়ারলাইন সস্তায় সেবা দিতে পারছে, অথচ নিজের দেশের বিমান সংস্থা লোভে অন্ধ হয়ে আকাশছোঁয়া ভাড়া বসাচ্ছে। মনে হয় যেন তারা আমাদের চোখের পানি আর ঘামের দামে ব্যবসা করছে। এটা কি শুধু ব্যবসা? নাকি পরিকল্পিত শোষণ?
বিমানের দীর্ঘদিনের কুকীর্তি
- দুর্নীতি আর কমিশন বাণিজ্য: টিকিটের ভাড়ার বড় অংশ চলে যায় কমিশন সিন্ডিকেটে। ভিআইপি, রাজনৈতিক নেতাদের বিনামূল্যে টিকিটের খরচ ওঠানো হয় সাধারণ প্রবাসীদের পকেট থেকে।
- অপমানজনক সেবা: বিদেশি এয়ারলাইন যেখানে হাসিমুখে সেবা দেয়, বিমান বাংলাদেশে ওঠার পর মনে হয় যেন যাত্রীরা বোঝা হয়ে গিয়েছে।
- সময়ানুবর্তিতার অভাব: ফ্লাইট দেরি, হঠাৎ বাতিল, যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে বসিয়ে রাখা—এগুলো নিত্যদিনের ঘটনা।
- রক্ষণাবেক্ষণের দুরবস্থা: পুরনো বিমান, খারাপ খাবার, অনিয়মিত পরিষ্কার—সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক মান থেকে বহু দূরে।
- সিট ও লাগেজের ঝামেলা: প্রবাসীরা লাগেজ নিয়ে প্রায়ই হয়রানির শিকার হন, সিট বুকিং করেও শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়।
প্রবাসীদের প্রতি অবিচার
বিদেশি সালাম এয়ার ৩১ রিয়ালে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে কারণ তারা দক্ষ ব্যবস্থাপনা চালায়, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং যাত্রীকে ব্যবসার অংশীদার ভাবে। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স? তারা যাত্রীকে ভাবে লুট করার সুযোগ। বাংলাদেশী হয়েও বাংলাদেশীর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা নেওয়া—এটা এক ধরনের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা।
বিমানের ব্যর্থতার ইতিহাস
বিমান বাংলাদেশ একসময় ছিল দেশের গর্ব। কিন্তু এখন সেটি দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা আর লোভের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। একের পর এক কেলেঙ্কারি, অযৌক্তিক খরচ, অনিয়মিত সেবা—সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নতুন বিমান কেনা হয়েছে, কিন্তু সেবা মান উন্নত হয়নি। কর্মীদের পেশাদারিত্বের অভাব, কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক নিয়োগ, আর ম্যানেজমেন্টের উদাসীনতা সব মিলে প্রতিষ্ঠানটিকে আরও পচিয়ে দিচ্ছে।
অন্যায়ের উদাহরণ
বছরের পর বছর ধরে প্রবাসীরা অভিযোগ করে আসছে—বিদেশি এয়ারলাইনের তুলনায় একই রুটে বিমানের টিকিট সবসময় বেশি দামে বিক্রি হয়। শুধু তাই নয়, উৎসবের সময়, ঈদ-পূজায় টিকিটের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ বিদেশি এয়ারলাইন এমন সময়ে বিশেষ ছাড় দেয়, যাতে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরতে পারে।
সময় ও সেবার মান
বিমান বাংলাদেশে সময়মতো ফ্লাইট ছাড়ার রেকর্ড প্রায় নেই বললেই চলে। একাধিকবার দেখা গেছে—যাত্রীদের বোর্ডিং পাস দেওয়ার পরও ফ্লাইট ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেরি করেছে, এমনকি বাতিল হয়েছে। যাত্রীদের জন্য খাবার বা থাকার ব্যবস্থা করা হয়নি, প্রবাসীরা মেঝেতে বসে রাত কাটিয়েছেন। এসব ঘটনা প্রবাসীদের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
প্রশ্ন যেগুলোর উত্তর আজও মেলেনি
- কেন সালাম এয়ার ৩১ রিয়ালে লাভ করতে পারে অথচ বিমান বাংলাদেশ ৭৯ রিয়াল ছাড়া চলতে পারে না?
- নিজের দেশের নাগরিকদের জন্য ছাড় না দিয়ে বরং বেশি দাম বসানোর পেছনে কার স্বার্থ?
- রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য কি—জনগণের সেবা, নাকি জনগণের পকেট ফাঁকা করা?
সমাধান কি?
প্রবাসীরা আর এই লুট মেনে নেবে না।
- বিমান বাংলাদেশকে ভাড়ার নীতি পুনর্গঠন করতে হবে।
- বিদেশি এয়ারলাইনের সাথে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনা উচিত।
- দুর্নীতি আর কমিশন সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলা জরুরি।
- প্রবাসীদের জন্য আলাদা ডিসকাউন্ট নীতি চালু করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- সেবার মান উন্নত করা এবং সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করতে হবে।
শেষ কথা
আমরা প্রবাসীরা আকাশে উড়ে বাড়ি ফিরতে চাই আনন্দ নিয়ে, অপমান আর লুটপাটের ক্ষোভ নিয়ে নয়। সালাম এয়ার ৩১ রিয়ালে নিতে পারে—বিমান বাংলাদেশ কেন ৭৯ রিয়াল চাইবে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে প্রমাণ হয়ে যাবে—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আসলে প্রবাসীদের জন্য নয়, প্রবাসীদের রক্ত চুষে খাওয়ার জন্যই বেঁচে আছে।
Join the conversation