সাপের কামড়ে মৃত্যু: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নির্মম ব্যর্থতা
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল মানেই কৃষি, নদী-নালা, খাল-বিল আর বিস্তৃত মাঠ। এই সবুজ প্রকৃতির মাঝেই বাস করে মানুষের এক অদৃশ্য শত্রু—সাপ। গ্রামীণ কৃষক, দিনমজুর, শিশু কিংবা গৃহিণী—কেউ সাপের কামড় থেকে নিরাপদ নয়। আমাদের দেশে বছরে হাজার হাজার মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে বহু মানুষ প্রাণ হারায়। অথচ ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, যারা হাসপাতালে পৌঁছায়, তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জানানো হয়—"আমাদের কাছে এন্টিভেনম নেই।"
এ যেন এক নির্মম পরিহাস। একজন মানুষ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে শুনছেন তার বাঁচার একমাত্র ভরসা এন্টিভেনম নেই! এ কি কোনো সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে? বাংলাদেশ কি এতটাই অসহায় যে সাধারণ নাগরিকদের জীবন রক্ষার এই ন্যূনতম ওষুধটুকুও সরকার সরবরাহ করতে পারছে না?
সাপের কামড়ে মৃত্যুর বাস্তব চিত্র
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে আনুমানিক ৬-৮ হাজার মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে শুধুমাত্র একটি সাপের কামড় থেকে। অথচ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাপের কামড় প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা বহু আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে—অ্যান্টিভেনম।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশের মানুষ কেন প্রতিদিন মরছে? কেন হাসপাতালে গিয়ে তারা ওষুধ পাচ্ছে না? কেন উপজেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত রোগীকে জানাতে হয়, "এন্টিভেনম নেই"?
এন্টিভেনম: জীবন রক্ষার অস্ত্র
সাপের কামড়ের চিকিৎসায় একমাত্র কার্যকর ওষুধ হলো এন্টিভেনম। এটি সাপের বিষকে নিস্ক্রিয় করে রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। অনেক দেশেই এন্টিভেনম উৎপাদন হয় এবং সরকারিভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরবরাহ করা হয়। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এন্টিভেনম সহজলভ্য।
কিন্তু বাংলাদেশে?
বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি বিদেশনির্ভর। ভারতের তৈরি এন্টিভেনম আমদানি করা ছাড়া আমাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই। অথচ ভারতীয় এন্টিভেনম বাংলাদেশের সব প্রজাতির সাপের জন্য পুরোপুরি কার্যকর নয়। এর ফলে চিকিৎসকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন, রোগীর জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
সরকারের অবহেলা – এক অমানবিক নীরবতা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বছরের পর বছর ধরে এ বিষয়টি জানে। তারা জানে সাপের কামড়ে মানুষ মরছে, তারা জানে হাসপাতালে এন্টিভেনম নেই, তারা জানে উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো সম্পূর্ণ খালি। তবুও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
কোনো কাগুজে ফাইলে হয়তো লেখা থাকে, "এন্টিভেনম বিতরণ চলছে"। অথচ বাস্তবে গ্রামে গেলে দেখা যায়, একজন কৃষক কামড়ে আক্রান্ত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে চিকিৎসক তার হাত তুলে দেন। তাকে রেফার করে দেন জেলা হাসপাতালে। জেলা হাসপাতালে গেলে শোনা যায় একই কথা—"আমাদের কাছেও নেই।" এরপর শুরু হয় মরদেহ ফেরানোর করুণ যাত্রা।
সাধারণ মানুষের অসহায়তা
একজন কৃষক বা গরীব মানুষ যখন সাপের কামড়ে আক্রান্ত হন, তখন তিনি প্রথমেই আশেপাশের গ্রাম্য ডাক্তার বা কবিরাজের কাছে ছুটে যান। অনেক সময় ভুল চিকিৎসা ও বিলম্বে রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। যারা কোনোভাবে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন, তাদের হতাশা আরও গভীর হয়, কারণ সেখানেও এন্টিভেনম নেই।
এ যেন মৃত্যুকে তাড়িয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত আসা, আর সেখানেই মৃত্যুর হাতে আত্মসমর্পণ করা।
একজন মা তার সন্তানের চোখের সামনে মারা যান, একজন বাবা তার শিশুকে বাঁচাতে পারলেও হাসপাতালে গিয়ে শোনেন—"আমাদের কিছু করার নেই।"
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি কঠিন প্রশ্ন
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে সরাসরি বলতে চাই:
- আপনারা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে, বিদেশ ভ্রমণে, বিলাসবহুল সম্মেলনে।
- অথচ সাপের কামড়ে প্রতিদিন ২০ জন মানুষ মারা যাচ্ছে—এই মৃত্যু থামাতে আপনারা কি করেছেন?
- কেন এখনো দেশে এন্টিভেনম উৎপাদন কারখানা হয়নি?
- কেন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এন্টিভেনম মজুদ নেই?
- কেন বাংলাদেশের মানুষকে আজও মৃত্যুর মুখে ঠেলে রাখা হচ্ছে?
এটা শুধু অবহেলা নয়, এটা সরাসরি অপরাধ।
কারণ, যখন সরকারের হাতে সমাধান আছে অথচ ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণকে সেই সমাধান থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন সেটি খুনেরই শামিল।
সাপের কামড়: শুধু গ্রামীণ নয়, জাতীয় সমস্যা
অনেকে হয়তো ভাবেন সাপের কামড় শুধু গ্রামীণ মানুষের সমস্যা। শহরের মানুষ বাঁচলেই সব ঠিক। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভয়ঙ্কর ভুল। বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। আমাদের খাদ্য উৎপাদনকারীরা, যারা মাঠে কাজ করে, তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। তাদের মৃত্যু মানে শুধু একটি পরিবার নয়, পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাই সাপের কামড় কেবল গ্রামীণ সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা।
জাতীয় সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হলে সরকার তার দায়িত্বে ব্যর্থ।
জনগণের পক্ষে কিছু কথা
আমি আজ সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে বলতে চাই—
- আমরা আর শুনতে চাই না "এন্টিভেনম নেই"।
- আমরা চাই, প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমাণ এন্টিভেনম মজুদ থাকুক।
- আমরা চাই, বাংলাদেশ নিজের এন্টিভেনম উৎপাদন শুরু করুক।
- আমরা চাই, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুক।
🚨 জরুরি বার্তা
যদি সরকার ব্যর্থ হয়, তবে এই মৃত্যু তাদের দায়, তাদের অপরাধ।
সাপের কামড়ে প্রতিদিন যে রক্ত ঝরছে, তার প্রতিটি বিন্দুর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়ী।
এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য একটি জোরালো দাবি। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই গুরুতর সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
Join the conversation