
সমাজে সত্য বলা সবসময় সহজ নয়
সমাজে সত্য বলা সবসময় সহজ নয়। বরং সত্য বলা মানে প্রায়শই নিজের বিপদ ডেকে আনা। তবুও ইতিহাস সাক্ষী—যেসব মানুষ সত্যকে আঁকড়ে ধরেছে, তাদের কণ্ঠস্বর যুগে যুগে অন্যদের জাগিয়েছে। অন্যায় যখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তখন সেটাকে ভাঙতে পারে একটাই শক্তি—সত্যের কণ্ঠস্বর।
কিন্তু সমস্যা হলো, সত্য বলার পথে দাঁড়িয়ে থাকে এক অদৃশ্য দেয়াল ভয়ের দেয়াল। এই ভয় এতটাই শক্তিশালী যে মানুষ অন্যায় জানলেও মুখ খোলে না। ভয়কে ভেঙে সত্য বলা একদিকে ব্যক্তিগত সাহসের পরীক্ষা, অন্যদিকে সমগ্র সমাজের মুক্তির দরজা।
ভয়ের দেয়াল: মানুষের নীরবতার আসল কারণ
ভয় মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে যখন এই ভয় অযৌক্তিকভাবে সমাজকে চেপে ধরে, তখন সেটি এক বিশাল দেয়ালে পরিণত হয়।
- চাকরি হারানোর ভয় – কেউ ঘুষের বিরোধিতা করলে পদ হারানোর আশঙ্কা থাকে। – অফিসে সত্য বলা মানেই “ঝামেলাপ্রিয়” তকমা।
- ক্ষমতাবানদের রোষের ভয় – রাজনীতিবিদের অন্যায় ফাঁস করলে শত্রু তৈরি হয়। – ক্ষমতাধর ব্যক্তি শাস্তি দিতে পারে—এই ভয় মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়।
- সমাজচ্যুত হওয়ার ভয় – সত্য বললে অনেক সময় সমাজে একঘরে হতে হয়। – প্রতিবেশী, আত্মীয় বা বন্ধুর চোখে “বিরোধী” হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- শারীরিক ক্ষতির ভয় – সত্য প্রকাশের জন্য অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। – এ কারণে মানুষ ভাবে: “বেঁচে থাকাই ভালো, সত্য বলার দরকার কী?”
আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার মন্তব্য করেছিলেন।
“ভয় আসলে সত্যকে হত্যা করে না, বরং আমাদের ভেতরের সাহসকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।”
সত্যের কণ্ঠস্বরের শক্তি
ভয় যতই বড় হোক না কেন, সত্যের কণ্ঠস্বরের একটা অদ্ভুত শক্তি আছে। এই শক্তি ইতিহাস বদলে দিয়েছে, সমাজকে নাড়া দিয়েছে।
- সত্য অন্যায়কে উন্মোচন করে – যত অন্ধকারই হোক, সত্য আলো ফেলে অন্যায়কে প্রকাশ করে। – সমাজ বুঝতে শেখে কারা অপরাধী, কারা ন্যায়ের পক্ষে।
- সাহস জাগিয়ে তোলে – একজন মানুষ সত্য বললে অন্যরাও সাহসী হয়। – ছোট ছোট কণ্ঠস্বর একত্রে বড় শক্তিতে রূপ নেয়।
- সমাজের বিবেক জাগিয়ে তোলে – দীর্ঘদিনের নীরবতা ভাঙে। – মানুষ বুঝতে পারে চুপ থাকা মানে অন্যায়কে শক্তিশালী করা।
- ইতিহাসে চিহ্ন রেখে যায় – সত্য বলা মানুষ হয়তো কষ্ট পায়, কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাকে মনে রাখে।
সত্য বলার উদাহরণ: বাস্তব থেকে শিক্ষা
গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা অনেক সাংবাদিক অন্যায় প্রকাশ করতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন, এমনকি জীবনও। কিন্তু তাদের লেখা সমাজকে কাঁপিয়ে তুলেছে। হুইসেল ব্লোয়াররা যারা দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে, তারা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক ঝুঁকি নেন। কিন্তু তাদের সাহসী পদক্ষেপের কারণেই বড় বড় কেলেঙ্কারি প্রকাশ পায়। সাহিত্য ও শিল্পী সমাজ লেখক ও শিল্পীরা প্রায়ই সত্যকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তাদের কলম সমাজের অচেতন মনকে জাগিয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুনও একবার একটি সমাবেশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—
“আমি একা সত্য বললে হয়তো আমাকে হার মানতে হবে, কিন্তু যদি তোমরা সবাই আমার সঙ্গে সত্য বলো, তাহলে অন্যায়ের দেয়াল ভেঙে পড়বেই।”
ভয়ের দেয়াল ভাঙার উপায়
- ছোট ছোট পদক্ষেপে শুরু করা – বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে একবারে দাঁড়ানো কঠিন। – প্রথমে ছোট অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সাহস বাড়ে।
- দল গঠন করা – একা সত্য বললে ভয় কাজ করে, কিন্তু একসঙ্গে বললে ভয় কমে। – সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শক্তিশালী হয়।
- শিক্ষা ও সচেতনতা – নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে সত্যের গুরুত্ব। – পরিবারে শিশুদের বলতে হবে, সত্য লুকানো মানে অপরাধকে বাড়ানো।
- আইনের সঠিক ব্যবহার – ভয় কাটাতে হলে মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে, আইন সত্যের পক্ষে কাজ করবে। – ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে সত্য বলার প্রবণতা বাড়বে।
- আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি – সত্য বলার আগে মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে নিজের নীতিতে। – “কি হবে” ভেবে চুপ না থেকে “কি হওয়া উচিত” ভেবে এগিয়ে যেতে হবে।
সত্যের কণ্ঠস্বরের ফলাফল
- অন্যায়কারীরা অস্বস্তিতে পড়ে – তারা বুঝতে পারে, আর আগের মতো সহজে ধরা এড়ানো যাবে না।
- মানুষের সাহস বাড়ে – একজন সাহসী মানুষ অনেককে অনুপ্রাণিত করে।
- সমাজে নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে – নীরবতার বদলে কথা বলার, সত্য বলার সংস্কৃতি তৈরি হয়।
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয় – যখন মানুষ সত্য বলে, তখন আইনও কার্যকর হতে বাধ্য হয়।
সত্যের কণ্ঠস্বর কখনো সহজ পথে শোনা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন ত্যাগ, সাহস এবং ভয় ভাঙার শক্তি। সমাজে যতদিন ভয়ের দেয়াল অটুট থাকবে, ততদিন সত্য চাপা পড়ে থাকবে। কিন্তু একবার যদি সেই দেয়াল ফেটে যায়, তবে সত্যের আলো অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসবেই।
আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার লিখেছিলেন—
“সত্য একদিনে জয়ী হয় না, কিন্তু প্রতিদিন যে কণ্ঠস্বর সত্য বলে, সে-ই ভয়ের দেয়ালকে ধীরে ধীরে ভেঙে ফেলে।”
সমাজের পরিবর্তন শুরু হয় একজন মানুষের মুখ খোলা থেকে। আর সেই কণ্ঠস্বরই একসময় অন্যায়ের শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
Join the conversation