
অন্যায়ের সংস্কৃতি – নীরবতার চক্র
সমাজে অন্যায় নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে অন্যায় ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে— যতক্ষণ না মানুষ নিজের বিবেককে অটল রাখতে শিখে। কিন্তু সমস্যা শুধু অন্যায়ের উপস্থিতি নয়, বরং সমাজে অন্যায়কে ঘিরে যে “নীরবতার সংস্কৃতি” তৈরি হয়, সেটিই সবচেয়ে ভয়াবহ। এই নীরবতা এক ধরনের অদৃশ্য দেয়াল, যা একদিকে অন্যায়কারীদের রক্ষা করে, অন্যদিকে সৎ মানুষদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখে।
অন্যায়ের শুরু: ছোট ভুল থেকে বড় অপরাধে
প্রত্যেক সমাজে অন্যায় শুরু হয় ছোট থেকে।
- স্কুলে শিক্ষক প্রিয় ছাত্রকে বাড়তি নম্বর দিলেন, অন্য ছাত্র বঞ্চিত হলো।
- অফিসে ম্যানেজার আত্মীয়কে চাকরির সুযোগ দিলেন, যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ল।
- রাজনীতিতে একজন নেতা সুবিধার জন্য ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর চেপে রাখলেন।
এগুলোকে সমাজ “ছোটখাটো ঘটনা” ভেবে চুপ থাকে। কিন্তু সত্য হলো—এই ছোট অন্যায়ই ধীরে ধীরে জমতে জমতে বড় অপরাধের ভিত্তি গড়ে তোলে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন একবার নিজের চোখে দেখেছিলেন, বাজারে একজন ব্যবসায়ী ওজন কম দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। লোকজন দেখেও কিছু বলেনি। কারণ সবার মনে একই চিন্তা—“আমার সাথে তো হচ্ছে না, বললে সমস্যা হতে পারে।” এভাবেই এক ছোট প্রতারণা সমাজের চোখে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
নীরবতার সংস্কৃতি: কেন মানুষ চুপ থাকে
মানুষ অন্যায় দেখেও চুপ করে থাকে, এর পিছনে রয়েছে নানা কারণঃ
- ভয় – অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললে চাকরি হারানোর ভয়, ক্ষমতাবানদের রোষানলে পড়ার ভয়, সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়।
- অভ্যাস – দীর্ঘদিন অন্যায় দেখে মানুষ একসময় এটাকে স্বাভাবিক ধরে নেয়। যেমন, কেউ ঘুষ নিলেও অনেকে ভাবে—“এটাই তো নিয়ম।”
- স্বার্থ – চুপ থাকা মানেই সুবিধা পাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, একজন কর্মকর্তা দুর্নীতির কথা জানেন, কিন্তু চুপ থেকে তিনি পদোন্নতি পান।
- উদাসীনতা – “আমার কি আসে যায়?”—এই মানসিকতা নীরবতার বড় কারণ।
অন্যায় কীভাবে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়
যখন একটি সমাজে বারবার অন্যায় হয় এবং মানুষ নীরব থাকে, তখন সেটাই ধীরে ধীরে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।
- অফিসে ঘুষ দেওয়া না দিলে কাজ হয় না—এটা একসময় অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়।
- স্কুলে শিক্ষককে উপহার দিলে ভালো ফল হয়—এটা অভিভাবকদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস হয়ে যায়।
- রাজনীতিতে ক্ষমতাধররা আইন ভাঙলেও কেউ প্রশ্ন তোলে না—এটা সমাজে গৃহীত বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়।
একসময় নতুন প্রজন্মও দেখে শিখে—“এটাই আসল নিয়ম।” অন্যায় তখন আর ব্যতিক্রম থাকে না, বরং “চলতি প্রথা” হয়ে যায়।
নীরবতার চক্র: প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
- প্রথম প্রজন্ম অন্যায় দেখে চুপ থাকে।
- দ্বিতীয় প্রজন্ম চুপ থাকাকে স্বাভাবিক ধরে।
- তৃতীয় প্রজন্ম অন্যায় করাকেও স্বাভাবিক মনে করে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রায়ই ভাবেন, এই চক্র ভাঙতে হলে প্রথমেই মানুষকে নিজের ভেতরের ভয় কাটাতে হবে। কারণ ভয়ই হলো সেই শেকল, যা মুখ বন্ধ করে রাখে।
বাস্তব জীবনের উদাহরণ
- গণপরিবহন: চালক ট্রাফিক আইন ভাঙে, পুলিশ দেখে চুপ থাকে কারণ ঘুষ নিয়েছে। যাত্রী দেখে চুপ থাকে কারণ তাড়াহুড়ো আছে।
- বিচারব্যবস্থা: ধনী অপরাধী প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়, গরিব মানুষ ছোট অপরাধে বছরের পর বছর জেলে থাকে। জনগণ দেখেও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তাই আর প্রতিবাদ করে না।
- স্বাস্থ্যখাত: হাসপাতালের চিকিৎসক ওষুধ কোম্পানির কমিশন নেন, রোগী কষ্টে পড়ে। রোগীর পরিবারও কিছু বলে না, কারণ অন্য চিকিৎসকও একই রকম।
অন্যায় ও নীরবতার ক্ষতিকর প্রভাব
- বিশ্বাস ধ্বংস হয় – মানুষ আর প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করে না।
- সততার মৃত্যু ঘটে – সৎ মানুষরা ভেঙে পড়ে, অন্যায়কারীরা প্রভাবশালী হয়।
- অর্থনৈতিক ক্ষতি – দুর্নীতির কারণে সমাজে উন্নয়নের গতি কমে যায়।
- নৈতিক অবক্ষয় – নতুন প্রজন্ম শিখে যে ন্যায়ের চেয়ে অন্যায়ে সুবিধা বেশি।
- মানসিক চাপ – সাধারণ মানুষ অসহায় বোধ করে, হতাশায় ভোগে।
নীরবতা ভাঙার উপায়
- সচেতনতা তৈরি – মানুষকে জানাতে হবে নীরবতাই আসল সমস্যার মূল।
- সাহসী কণ্ঠস্বর – কয়েকজন মানুষ যদি সত্য বলতে শুরু করে, অন্যরাও সাহস পায়।
- আইনের শাসন – অন্যায়কারীদের শাস্তি দিতে হবে, নাহলে সংস্কৃতি ভাঙবে না।
- শিক্ষা ও পরিবার – ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শেখাতে হবে, অন্যায় দেখলে চুপ থাকা অপরাধ।
- স্বাধীন গণমাধ্যম – সত্য প্রকাশের সবচেয়ে বড় শক্তি।
আব্দুল্লাহ আল মামুন বিশ্বাস করেন, একজন মানুষও যদি সত্য বলতে শুরু করে, তাহলে ধীরে ধীরে তার কণ্ঠস্বর অন্যদের জাগিয়ে তুলবে।
“অন্যায়ের সংস্কৃতি – নীরবতার চক্র” হলো এক অদৃশ্য কারাগার, যেখানে সমাজের অধিকাংশ মানুষ বন্দি। অন্যায়কারীরা তো শক্তিশালী, কিন্তু তাদের চেয়ে ভয়ঙ্কর হলো সেই নীরব জনগোষ্ঠী, যারা সত্য দেখেও মুখ খোলে না।
একদিন যদি এই নীরবতার দেয়াল ভেঙে যায়, তবে অন্যায়ের সাম্রাজ্যও ধসে পড়বে। সমাজের জন্য দরকার সাহসী কণ্ঠস্বর, দরকার নীরবতা ভাঙার সাহস।
যেমন আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রায়ই বলেন— “অন্যায় একদিন থেমে যাবে, যদি আমরা সবাই মিলে নীরবতার চক্র ভাঙতে পারি।”
Join the conversation