কুমিল্লায় নারীর উপর নৃশংস হত্যাচেষ্টায় জনমনে ক্ষোভ, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিয়ে উদ্বেগ
দৈনিক তথ্য তরঙ্গ
সত্যের পথে নির্ভীক সংবাদ
কুমিল্লায় নারীর উপর নৃশংস হত্যাচেষ্টায় জনমনে ক্ষোভ, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিয়ে উদ্বেগ

২০২৫ সালের ১ জুলাই, মঙ্গলবার ভোররাতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের এক শান্ত গ্রামে ঘটে গেল এক নারকীয় সহিংসতার ঘটনা, যা গ্রামবাসীদের স্তম্ভিত করে দেয়। ৪৬ বছর বয়সী খোদেজা বেগম নামের এক নারী তাঁর নিজ বাড়িতে ভয়াবহ হত্যাচেষ্টার শিকার হন। ঘটনাটি ঘটে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী ইউনিয়নের অন্তর্গত ঝিকড্ডা গ্রামে।
স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, অভিযুক্ত ব্যক্তি—৩৮ বছর বয়সী এমদাদুল হক শাহীন, যিনি একই গ্রামের বাসিন্দা ও একজন পেশাদার রঙমিস্ত্রি—মধ্যরাতে খোদেজার বাড়িতে ঢুকে গলায় ছুরি চালিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালায়। হামলার পেছনে কী উদ্দেশ্য ছিল, তা তদন্তাধীন রয়েছে।
রাত আনুমানিক ২টা ৩০ মিনিটে খোদেজা বেগম নিজ ঘরে অবস্থান করছিলেন। এ সময় বিনা পূর্বাভাসে অভিযুক্ত শাহীন তাঁর উপর আক্রমণ চালায়। একটি ধারালো ছুরি দিয়ে খোদেজার গলার দিকে সোজা আঘাত করে সে, যার লক্ষ্য ছিল সরাসরি তাঁকে হত্যা করা।
খোদেজার চিৎকার ও প্রাণপণ প্রতিরোধের শব্দ শুনে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে খোদেজাকে গুরুতর আহত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করে। তাঁকে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং দ্রুত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।
স্থানীয় চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর অবস্থা "চরম আশঙ্কাজনক হলেও জরুরি সেবার আওতায় স্থিতিশীল।"
চৌদ্দগ্রাম থানার পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপে অভিযুক্ত এমদাদুল হক শাহীনকে ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়। সে গ্রেপ্তারের সময় কোনো ধরনের প্রতিরোধ করেনি। প্রাথমিক তদন্তে পূর্ববতী বিরোধ বা পূর্বপরিকল্পিত হামলার ইঙ্গিত মিলেছে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে যাতে হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং কোনো সহযোগী জড়িত আছে কিনা তা জানা যায়।
"আমরা এই মামলাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে এবং যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।"
- মোহাম্মদ হিলাল উদ্দিন আহমেদ, অফিসার ইনচার্জ, চৌদ্দগ্রাম থানা
এই নৃশংস হামলার ঘটনাটি কুমিল্লা জেলাজুড়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অনেকেই দ্রুত বিচার ও গ্রামাঞ্চলের নারীদের জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন। স্থানীয় মানুষ থানার সামনে ও হাসপাতালে জড়ো হয়ে তদন্তে স্বচ্ছতা এবং অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান।
"এই বর্বরোচিত হামলা নারীদের নিজেদের ঘরে পর্যন্ত কতটা অরক্ষিত তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। বিচার যেন শুধু দ্রুতই না হয়—তা যেন দৃষ্টান্তমূলক হয়।"
- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
এই ঘটনাটি বাংলাদেশে বিশেষত গ্রামীণ ও পশ্চাৎপদ এলাকায় নারীদের উপর সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার একটি অংশ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই ১,২০০টিরও বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে, যার বড় অংশটি পারিবারিক বা স্থানীয় সূত্রে সংঘটিত।
যদিও আইনগত সংস্কার ও জাতীয় হেল্পলাইন চালু রয়েছে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখনও ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা কমিউনিটি পুলিশিং, সচেতনতামূলক কর্মসূচি এবং নারী-সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ প্রয়োগে জোর দিচ্ছেন।
এই মামলাটি যেসব জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, তা হলো:
- নারীর প্রতি সহিংসতার মামলাগুলোর জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণ
- গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতামূলক ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি চালু
- ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের জন্য মনোসামাজিক ও আইনগত সহায়তা
- পুলিশ ও বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ
খোদেজা বেগমের উপর এই হত্যাচেষ্টা নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি বাংলাদেশের বৃহৎ নারী নির্যাতনের সংকটের প্রতিচ্ছবি। এটি শুধুমাত্র একটি জাতীয় সংকট নয়—এটি একটি মানবাধিকার ইস্যু, যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও সংহতি দাবি করে।
তদন্তের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পুরো জাতির, এমনকি বিশ্ববাসীর নজর এখন ঝিকড্ডা গ্রামের দিকে—বিচার, উত্তর ও আশার অপেক্ষায়।
Join the conversation