কুমিল্লা: ইতিহাসের গৌরব ও "ইতর" শব্দের অপব্যবহারের সত্যতা
কুমিল্লা: ইতিহাসের গৌরব ও "ইতর" শব্দের অপব্যবহারের সত্যতা

বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের এক প্রাচীন জনপদ কুমিল্লা, যার ইতিহাস যেমন গৌরবময়, তেমনি এর ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে এক অনন্য পরিচয় বহন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, সময়ের ব্যবধানে কুমিল্লার মানুষদের নিয়ে "ইতর" শব্দটি ব্যবহার করে এক ধরনের নেতিবাচক উপহাস গড়ে উঠেছে। এই নিবন্ধে আমরা একদিকে যেমন কুমিল্লার ঐতিহ্য, গৌরব ও সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরব, তেমনি পর্যালোচনা করব কেন এবং কিভাবে "ইতর" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ও এর প্রকৃত অর্থ কী।
১. প্রাচীনকাল ও জনপদের ইতিহাস
কুমিল্লা একসময় সমতট জনপদের অংশ ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে এখানে সভ্যতা গড়ে ওঠে, যার নিদর্শন পাওয়া যায় ময়নামতি ও শালবন বিহার অঞ্চলে।
পাল ও সেন যুগে এটি ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
২. ময়নামতি ও শালবন বিহার – ঐতিহ্যের ধ্বংসাবশেষ
কুমিল্লার ময়নামতিতে রয়েছে বহু প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার, যা প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ শিক্ষার এক কেন্দ্র ছিল। শালবন বিহার একটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়সম স্থাপনা ছিল, যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসত ধর্ম ও জ্ঞানের খোঁজে।
৩. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কুমিল্লা
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম সহযোগী কেন্দ্র ছিল কুমিল্লা। বিপ্লবীদের অন্যতম সহায়তা ছিল এখানকার জনগণ ও নেতৃত্বের।
কুমিল্লায় বহু স্বদেশী বিপ্লবী গড়ে উঠেছিল। কুমিল্লা জেলার শ্রীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুশীল সেন ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাহসী মুখ।
৪. ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কুমিল্লার শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের নাম। এখানে গঠিত হয় বহু মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও ট্রেনিং সেন্টার। কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলায় গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
- শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্র: কুমিল্লার গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম, ফরিদা পারভীন, আবু তাহের, ইত্যাদি গুণীজন জাতীয়ভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
- শিক্ষা ও সাহিত্য: কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৮৯৯) বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
- প্রবাসীদের জেলা: বিপুল সংখ্যক কুমিল্লাবাসী প্রবাসে থেকে দেশের রেমিট্যান্স আয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন।
📌 "ইতর" শব্দের অর্থ
ইতর শব্দটি মূলত সংস্কৃত/বাংলা শব্দ। এর অর্থ:
- নিচু শ্রেণির লোক
- ছোটলোক বা রূঢ় ব্যবহারকারী
- অভদ্র ও অশিষ্ট আচরণকারী
📌 কুমিল্লাবাসীকে "ইতর" বলা কেন হয়?
বিভিন্ন জনশ্রুতি ও কৌতুকধর্মী কথাবার্তায় দেখা যায়, কুমিল্লার মানুষকে নিয়ে হাস্যরস করা হয় — "কুমিল্লার মানুষ ইতর হয়", ইত্যাদি। কিন্তু এর পেছনে কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, বরং এটি:
- সামাজিক বৈষম্য ও আঞ্চলিক বিদ্বেষ থেকে জন্ম নেওয়া এক প্রকার কুৎসা।
📌 সত্যিকারের কুমিল্লাবাসী কেমন?
- সাহসী, কর্মঠ ও সংগ্রামী — শত বাধার পরেও তারা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়।
- স্পষ্টভাষী ও প্রতিবাদী — অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে বলেই অনেকে তাদের রুঢ় মনে করেন।
- আতিথেয়তায় অনন্য — কুমিল্লার মানুষ অতিথি আপ্যায়নে এবং আন্তরিকতায় দেশের মধ্যে অন্যতম।
সত্য হলো: কুমিল্লার মানুষ ইতর নয়। তারা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, ইতিহাস-ঐতিহ্যে গৌরবময় এবং দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণকারী এক জনগোষ্ঠী।
📚 ২. ব্রিটিশ আমলে কুমিল্লার খ্যাতি
কুমিল্লা ছিল পূর্ব বাংলার অন্যতম শিক্ষিত ও প্রশাসনিকভাবে দক্ষ জনপদ।
এই অঞ্চলের মানুষরা ব্রিটিশ শাসনামলে রেলওয়ে, ডাক বিভাগ, টেলিগ্রাফ, এবং সরকারি অফিসে দক্ষতার সাথে কাজ করতেন।
অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশরা এই জনগোষ্ঠীকে "ITOR people" বা "ইতর" বলে ডাকত, যা ছিল এক ধরনের সার্টিফিকেট অফ মেরিট।
পরবর্তীকালে, যেসব মানুষ এই ব্যাখ্যার উৎস জানতেন না, তারা "ইতর" শব্দের বাংলা অভিধানভিত্তিক নেতিবাচক অর্থ গ্রহণ করে কুমিল্লাবাসীদের হেয় করে দেখা শুরু করে। ধীরে ধীরে এই শব্দটি এক সামাজিক স্টেরিওটাইপ-এ পরিণত হয়।
🗣️ ৩. ভাষার বিকৃতি ও সামাজিক মানসিকতা
ভাষা অনেক সময় পরিবর্তিত হয় রাজনৈতিক, সামাজিক বা উপনিবেশিক প্রভাবের কারণে।
"ইতর" শব্দটিরও একই পরিণতি হয়েছে বলে ধরা যায়।
"ইতর" শব্দের মূল প্রশংসাসূচক বা গুণমূলক ব্যাখ্যাটি হারিয়ে গিয়ে কেবল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে।
"ইতর" শব্দটি একসময় ব্রিটিশরা 'ITOR' নামে একধরনের সংক্ষিপ্ত রূপ (acronym) হিসেবে ব্যবহার করত, যার মানে ছিল:
I = Intelligent (বুদ্ধিমান)
T = Technical (কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন)
O = Organised (সংগঠিত)
R = Responsible (দায়িত্বশীল)
অর্থাৎ, তারা এই শব্দটি ব্যবহার করত কুমিল্লার মানুষের গুণাগুণ বোঝাতে — যারা ছিল মেধাবী, শিক্ষিত, দক্ষ এবং দায়িত্ববান।
কিন্তু সময়ের সাথে, যারা ইংরেজি ব্যাখ্যাটি জানত না, তারা বাংলা ভাষার প্রচলিত "ইতর = নিচু শ্রেণির মানুষ" এই অর্থে গ্রহণ করে ভুলভাবে কুমিল্লাবাসীদের হেয় করতে শুরু করে। ফলে একটি গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠে অপমানের প্রতীক।
ব্রিটিশ শাসন ও রাজনৈতিক জাগরণ
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরে কুমিল্লা আসে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে। এরপর শুরু হয় কুমিল্লার রাজনৈতিক জাগরণ:
- বিপ্লবী আন্দোলন: কুমিল্লায় গঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন, যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।
- কাজী নজরুল ইসলামের আগমন: তিনি এখানে এসে গণআন্দোলনে প্রেরণা জোগান এবং ভাষণ দেন।
- নারী জাগরণ: বেগম রোকেয়া ও অন্যান্য নারী নেত্রীরা কুমিল্লায় নারী শিক্ষা ও অধিকার বিষয়ে কাজ করেন।
ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার সংগ্রাম
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত কুমিল্লা ছিল সবসময়ই সোচ্চার।
ছাত্র আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, গ্রেফতার, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বহু কুমিল্লাবাসী।
কুমিল্লার স্কুল-কলেজগুলোতে ভাষা আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় সংগঠিতভাবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার ভূমিকা
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়:
- কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাক হানাদারদের শক্ত ঘাঁটি, কিন্তু এখানেই চালানো হয় সফল গেরিলা আক্রমণ।
- লাকসাম, দাউদকান্দি, ব্রাহ্মণপাড়া, চৌদ্দগ্রাম, মেঘনা অঞ্চল ছিল সম্মুখযুদ্ধের এলাকা।
- বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, অনেক গণকবর আজও কুমিল্লায় রয়ে গেছে।
কুমিল্লার শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
- বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিক্টোরিয়া কলেজ, ক্যান্টনমেন্ট কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে।
- সাহিত্য ও সংস্কৃতি: কাজী নজরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, রফিকুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সাহিত্যিকদের পদচারণায় কুমিল্লা সমৃদ্ধ।
- শিল্প ও সংগীত: কুমিল্লা নজরুলসংগীত, পালাগান, লোকসংগীতের জন্য বিখ্যাত।
No comments